শুক্রবার ৪ জুলাই ২০২৫ - ১০:৩৫
ইমাম হুসাইন (আ.) কেন পরিবারসহ কারবালায় গিয়েছিলেন?

কারবালার মহাকাব্য ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। একটি প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হয়: ইমাম হুসাইন (আ.) কেন তাঁর পরিবারকে এই বিপজ্জনক যাত্রায় সঙ্গে নিয়েছিলেন?

হাওজা নিউজ এজেন্সি: নিজ পরিবারকে এই বিপজ্জনক যাত্রায় সঙ্গে নেয়া কি শুধুই আবেগপ্রবণ একটি সিদ্ধান্ত ছিল, না কি এর পেছনে ছিল কোনো উচ্চতর কৌশল ও আল্লাহর নির্ধারিত পরিকল্পনা?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে ইসলামি ইতিহাস, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ইমামতের অন্তর্নিহিত জ্ঞান—সব কিছুকে একত্রে বিবেচনা করতে হবে।

পরিবারের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ
প্রথমত, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের সদস্যরা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে তাঁর সঙ্গে এই যাত্রায় অংশ নেন। কোনো জবরদস্তি বা চাপ ছিল না। এটি ছিল তাঁদের আন্তরিক সিদ্ধান্ত—তাঁরা আল্লাহর রাস্তায় দ্বীনের হেফাজতে ইমামের ঐশী সংগ্রামে শরিক হতে চেয়েছিলেন।

সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
প্রথম যুগের ইসলামে দীর্ঘ সফরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নেওয়া ছিল একটি প্রচলিত রীতি। বিশেষত কেউ যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজ শহর ছেড়ে অন্যত্র যেতেন, তখন স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে রাখা স্বাভাবিক ছিল। এই দিক থেকেও পরিবারের সঙ্গে থাকা একটি স্বাভাবিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত ছিল।

রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত কারণ
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মদিনায় ইমামের পরিবারের নিরাপত্তা। যেহেতু মদিনা ছিল উমাইয়া শাসনের আওতায়, সেখানে ইমামের পরিবার রেখে যাওয়া তাঁদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারত।

শত্রুপক্ষ তাঁদের জিম্মি করে ইমামের ওপর চাপ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করতে পারত। তাই পরিবারকে সঙ্গে নেওয়া ছিল একটি সচেতন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিবেচনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত।

ঐশী প্রজ্ঞা ও ইমামতের দৃষ্টিভঙ্গি
কিন্তু এই ঘটনাকে কেবল বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তা অসম্পূর্ণ থাকে। আসলে, এই সিদ্ধান্তের অন্তরালে ছিল আল্লাহর এক মহাপরিকল্পনা। যেমন ইমাম নিজেই বলেছিলেন,
إِنَّ اللَّهَ قَدْ شَاءَ أَنْ يَرَاهُنَّ سَبَايَا
—নিশ্চয়ই আল্লাহ চেয়েছেন যে, তিনি তাঁদের বন্দি অবস্থায় দেখুন।

আল্লাহর ইচ্ছা ছিল যে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবার এই বিপ্লবের কেন্দ্রে থাকবে, যেন তাঁরাই হন বিপ্লবের বার্তাবাহক ও সত্যের সংরক্ষক।

যদি এই পরিবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকত, যদি হযরত জয়নব (সা.) ও ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ঘটনাবলীর সরাসরি সাক্ষী না হতেন, তাহলে উমাইয়া শাসকরা নিশ্চয়ই কারবালার ইতিহাসকে বিকৃত করত। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ইমামের মহান আত্মত্যাগকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা, কিন্তু আহলে বাইতের বন্দিত্ব ও তাঁদের সাহসিকতা এই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয়।

বিশেষ করে হযরত জয়নব (সা.আ.)-এর সাহসিক ভাষণ এবং ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর নৈতিক দৃঢ়তা আশুরার বার্তাকে এমনভাবে রক্ষা করে, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি জ্বলন্ত দীপশিখা হয়ে উঠে।

উপসংহার
সুতরাং, পরিবারের এই সফরে অংশগ্রহণ ছিল না শুধুমাত্র সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রয়োজন—এটি ছিল আল্লাহর নির্ধারিত একটি মহাসাধনা।

কারবালার বিপ্লব শুধু একটি যুদ্ধ ছিল না, বরং একটি অবিচল ন্যায়ের পক্ষে সাক্ষ্য। এই সাক্ষ্য বহন করে ছিলেন ইমামের পরিবার, যারা বন্দিত্বের মধ্য দিয়েও সত্য ও ইসলামের আদর্শ রক্ষা করেছেন।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha